সমাবেশে জামায়াতের আমির
আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে
জামায়াতের ইতিহাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম সমাবেশ।
দলটির ঘোষণা, আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে দলের আমির শফিকুর রহমান। মঞ্চে রয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। ১৯ জুলাইছবি: প্রথম আলো |
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনাকীর্ণ সমাবেশে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেকটা লড়াইয়ের’ ঘোষণা দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। সেই সঙ্গে নির্বাচিত হয়ে তাঁর দল সরকার গঠন করতে পারলে কী কী করবে, সেই ঘোষণাও দিয়েছেন।
শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আগামীর বাংলাদেশটা কেমন হবে? আমি বলি, আরেকটা লড়াই হবে ইনশা আল্লাহ। একটা লড়াই হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।’ তিনি বলেন, ‘চাঁদা আমরা নেব না, দুর্নীতি আমরা করব না। চাঁদা আমরা নিতে দেব না, দুর্নীতি সহ্য করব না। এই বাংলাদেশটাই আমরা দেখতে চাই।’
গতকাল শনিবার বিকেলে শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাত দফা দাবিতে এই সমাবেশ হয়। সমাবেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার সময় পরপর দুবার অসুস্থ হয়ে মঞ্চে পড়ে যান শফিকুর রহমান। পরে বসা অবস্থায় তিনি বক্তৃতা শেষ করেন।
শফিকুর রহমান বলেন, ‘যদি আল্লাহর ইচ্ছায় ও জনগণের ভালোবাসায় জামায়াত থেকে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন, তাহলে কোনো এমপি-মন্ত্রী ভবিষ্যতে সরকারি কোনো প্লট গ্রহণ করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী ট্যাক্সবিহীন কোনো গাড়িতে চড়বেন না। কোনো এমপি-মন্ত্রী নিজের হাতে কোনো টাকা চালাচালি করবেন না। কোনো এমপি ও মন্ত্রী যদি তাঁর কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য থাকবেন।’
জামায়াতের ইতিহাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এটি প্রথম জনসমাবেশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ সমাবেশ দল এবং দলের আমির শফিকুর রহমানের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দলটি এটাকে জাতীয় সমাবেশ নাম দিয়েছে।
বেলা দুইটায় মূল বক্তব্য শুরু হলেও কার্যত সকাল ১০টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর হামদ, নাত ও ইসলামি সংগীত পরিবেশন করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পূর্ণ হয়ে একপর্যায়ে নেতা-কর্মীরা শাহবাগ মোড়, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন সড়কে বসে পড়েন। অনেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে বসানো ডিজিটাল পর্দায় নেতাদের বক্তব্য শোনেন।
সমাবেশে সমাপনী বক্তব্যে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘আবু সাঈদরা যদি বুক পেতে না দাঁড়াত, হয়তো আজকের এই বাংলাদেশটা আমরা দেখতাম না। তাই আসুন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার এই নিয়ামত পাওয়া, তাদের যেন অবজ্ঞা ও অবহেলা না করি, শিশু বলে তাদের যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি, অহংকার করে অন্য দলকে যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি। অরাজনৈতিক ভাষায় যেন আমরা কথা না বলি।’ তিনি বলেন, এসব যাঁরা পরিহার করতে পারবেন না, বুঝতে হবে ফ্যাসিবাদের রূপ তাঁদের মধ্যে নতুন করে বাসা বেঁধেছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আমরা কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সুশাসনের কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করতে চাই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভোট, দাঁড়িপাল্লার পক্ষে হোক। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলামী ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করব।’
দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, ৫৪ বছরে বাংলাদেশের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। নেতাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তিনি জামায়াতকে ভোট দিয়ে নির্বাচনে জয়ী করার আহ্বান জানান।
দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সংস্কার বিষয়ে চলমান আলোচনার বিষয়ে বলেন, ‘প্রত্যেকেই বলেন সংস্কার মানি। কিন্তু বৈঠকে বসলে কেউ কেউ “মানি না” ভাব দেখাচ্ছেন। সমস্যাটা কোথায়? সংস্কার তো সবার জন্য কল্যাণের। তাহলে যাঁরা চান না, তাঁদের মতলব আছে! পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল হবে না, তাহলে মতলব পূরণ হবে না। পিআর পদ্ধতিতে টাকা দিয়ে ভোট কেনার কোনো সুযোগ নেই, সে জন্য মতলব পূরণ হবে না।’
আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। সেটা ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বা রাজনৈতিক জঙ্গিবাদ হতে পারে। জামায়াত প্রয়োজনে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও ফ্যাসিবাদীদের কোনো বিচার এখনো দৃশ্যমান হয়নি উল্লেখ করে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনের আগেই এই বিচার সম্পন্ন করতে হবে। সরকারের ভেতরে-বাইরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। নতুন কোনো ফ্যাসিবাদ এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হবে না।
দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচনকে কালোটাকা, ফ্যাসিবাদ, মনোনয়ন-বাণিজ্য মুক্ত করতে এবং ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পিআর পদ্ধতির বিকল্প নেই। তিনি অবিলম্বে জুলাই সনদ প্রণয়ন ও পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানান।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন ও দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, শিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাজিবুর রহমান মোমেন প্রমুখ।
সঞ্চালনা করেন জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও উত্তরের সেক্রেটারি রেজাউল করিম।
ছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যরাও
জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরাও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বড় ভাই রমজান আলী বলেন, নির্বাচনের আগে শহীদদের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো ঘাপটি মেরে আছে। হত্যাকারীদের বিচার হলেই তারা আইনের আওতায় আসবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত শাহ আলম বলেন, এক বছর হয়ে যাচ্ছে, সরকার কোনো খোঁজখবর নেয়নি। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন, আহতদের চিকিৎসা নিয়ে কোনো কথা নেই। আগে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত, শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন করতে হবে, এরপর নির্বাচন দিতে হবে।
২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে নিহত হওয়া বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের পিতা বরকত উল্লাহও সমাবেশে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, ‘ছয় বছর পার হলেও আমার ছেলে হত্যার বিচার এখনো পাইনি। দ্রুত বিচার চাই। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আর কোনো র্যাগিং যেন না হয়, সরকারকে সেটা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। হল র্যাগিংয়ের মাধ্যমে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের তালিকা করার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।’
আরও বক্তব্য দেন গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ সাংবাদিক আবু তুরাবের ভাই আবুল হাসান, শহীদ শাহরিয়ার হাসানের পিতা আবুল হাসান ও শহীদ শান্তর পিতা জাকির হোসাইন।
অংশ নেন বিভিন্ন দলের নেতারা, ছিল না বিএনপি
জামায়াতের এই সমাবেশে আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা অংশ নেন, অনেকে বক্তব্যও দেন। তবে বিএনপির কোনো নেতাকে দেখা যায়নি।
বিএনপি ও জামায়াতের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সমাবেশে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়নি। তবে জামায়াতের আমিরের পক্ষে দলের একজন নেতা এ বিষয়ে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতার সঙ্গে কথা বলেন।
জামায়াতের ওই নেতা জানান, সমাবেশে তাঁরা বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানাতে চান। কিন্তু এই সমাবেশে তাঁদের অন্যতম দাবি হবে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। এ অবস্থায় বিএনপি সমাবেশে যাবে কি না। তখন বিএনপির ওই নেতা সমাবেশে না যাওয়া ভালো হবে বলে মন্তব্য করেন।
সমাবেশে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমদ, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রাব্বানি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন এজহার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আবু জাফর প্রমুখ। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাত থেকেই বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে ঢাকায় আসতে শুরু করেন দলটির নেতা, কর্মী, সমর্থকেরা। গতকাল ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলের দিকে যান দলটির নেতা-কর্মীরা।
সকাল থেকে সমাবেশস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতে থাকেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুখী যাত্রার কারণে রাজধানীর অনেক রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে মোড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে জামায়াতের স্বেচ্ছাসেবকদেরও। তবে লোকসমাগম বাড়লে যানজট নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে পুলিশকে। যানজট ও জনগণের ভোগান্তির উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর ফেসবুকের ভেরিফায়েড পেজে নগরবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।